প্রারম্ভিক শিক্ষা-
প্রারম্ভিক/ প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা হচ্ছে আনুষ্ঠানিক শিক্ষার জন্য একটি প্রস্ততিমূলক স্তর, যা শিশুর বিকাশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ উত্তরণ পর্যায়। এ পর্যায়ে উপযুক্ত যত্ন ও শেখার সুযােগ নিশ্চিত করে যে শিশুটি আনুষ্ঠানিক শিক্ষার জন্য প্রস্তুত এবং তা থেকে পুরােপুরি সুবিধা গ্রহণ করতে সক্ষম।
শিশু প্রারম্ভিক বিকাশ ও প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রমের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য-
লক্ষ্য:-
আনন্দময় ও শিশুবান্ধব পরিবেশে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার বয়সী শিশুদের (৩-৫ বছর) বয়স ও সামর্থ অনুযায়ী শারীরিক, মানসিক, আবেগিক, সামাজিক, বুদ্ধিবৃত্তীয় ও ভাষাবৃত্তীয় তথা সার্বিক বিকাশে সহায়তা নিয়ে পরবর্তী জীবনের শিখনভিত্তি রচনা করা এবং প্রাথমিক শিক্ষার অঙ্গনে তাদের সানন্দ ও স্বতঃস্ফূর্ত অভিষেক ঘটানো।
উদ্দেশ্যসমূহ:-
- আনন্দময় ও শিশুবান্ধব পরিবেশে বিভিন্ন খেলা, গল্প, ছড়া, গান ও বিভিন্ন কাজের মাধ্যমে শিশুর সক্রিয় অংশগ্রহণের সুযােগ সৃষ্টি করা;
- শেখার প্রতি ইতিবাচক মনােভাব সৃষ্টি করা;
- শিশুর সৌন্দর্য ও নান্দনিকতাবােধের বিকাশে সহায়তা করা;
- শিশুকে পারিবারিক ও সামাজিক পরিবেশ ও উপাদানের সঙ্গে পরিচয় ঘটানাে;
- নিজস্ব সাংস্কৃতিক আচার, কৃষ্টি ও ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচয়ের পাশাপাশি এর চর্চায় উৎসাহিত করা;
- নৈতিকতা, সামাজিক রীতিনীতি ও মূল্যবােধ বিকাশে সহায়তা করা;
- শিশুর স্থূল ও সূক্ষ্মপেশী তথা চলনশক্তির বিকাশে সহায়তা করা;
- শারীরিক সুস্থতা ও ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করা;
- শিশুর ভাষা ও যােগাযােগ দক্ষতা বিকাশে সহায়তা করা;
- গাণিতিক ধারণা, যৌক্তিক চিন্তা ও সমস্যা সমাধানের যােগ্যতা অর্জনে সহায়তা করা;
- পরিবেশের নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে কারণ ও ফলাফল সম্পর্ক অনুধাবনে সহায়তা করা;
- শিশুর স্বতঃস্ফূর্ত কল্পনা, সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবনী শক্তির বিকাশে সহায়তা করা;
- শিশুর আত্মবিশ্বাস ও আত্মমর্যাদা বিকাশে সহায়তা করা এবং নিজের কাজ নিজে করতে উদ্বুদ্ধ করা;
- আবেগ বুঝতে পারা ও তার যথাযথ প্রকাশে সহায়তা করা;
- শিশুকে পারস্পরিক সমঝােতা, সহযােগিতা ও ভাগাভাগি করতে সহায়তা ও উদ্বুদ্ধ করা।
মূলনীতি –
শিশুর বৃদ্ধি, বিকাশ ও শিখন তার পরিবার, চারপাশের পরিবেশ ও সমাজ দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়। তাছাড়া সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং শিশুর বিকাশ ও শিখনের অনন্য বৈশিষ্ট্যসমূহ এক্ষেত্রে উল্লেখযােগ্য ভূমিকা পালন করে। শিশুকে পরিপূর্ণভাবে বুঝে এবং তার বৈশিষ্ট্যসমূহের প্রতি যথাযথ গুরুত্ব আরােপ করে সমন্বিতভাবে প্রারম্ভিক শিক্ষা বাস্তবায়ন করতে হবে। শিশুর দৈনন্দিন শিখন-শেখানাে কার্যক্রম পরিচালনা করতে হলে ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে কিছু ধারণা, নীতি ও বিশ্বাস অনুসরণ করতে হয়। ফলে শিশুর সুপ্ত সম্ভাবনার সার্বিক বিকাশে সহায়তা করার পাশাপাশি তার পরবর্তী জীবনের শিক্ষার জন্য শক্ত ভিত রচনা করা সম্ভব হবে। তাই প্রারম্ভিক শিক্ষাক্রম প্রণয়নে ও বাস্তবায়নে নিমোক্ত ধারণা, নীতি ও বিশ্বাসসমূহকে মৌলিক নীতিমালা হিসেবে অনুসরণ করা হয়েছে ।
- শিশুকেন্দ্রিকতা (Child centeredness)
প্রারম্ভিক শিক্ষার একটি অন্যতম নীতি হলাে শিশুকে বােঝা, তার ক্ষমতায় আস্থা রাখা এবং তার স্বভাব, প্রকৃতি, ব্যক্তিত্ব ও মতামতের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা। শিশুর বৃদ্ধি, বিকাশ ও শিখন প্রধানত পরিবার, বিদ্যালয় এবং সমাজ দ্বারা প্রভাবিত হয়। পরিবার, বিদ্যালয় এবং সমাজ – এই তিনটি পর্যায়েই সমন্বিতভাবে কার্যক্রম গ্রহণ করা হলে তা শিশুর সুপ্ত ও অফুরন্ত সম্ভাবনা বিকাশে এবং সমৃদ্ধ জীবন যাপনের দিকে তাকে এগিয়ে নিতে সহায়তা করবে। ফলে শেখার মানসিকতা ও শেখার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টির মধ্য দিয়ে শিশু জীবনভর শিখনের (Lifelong learning) জন্য প্রস্তুত হয় ।
- সক্রিয় শিক্ষার্থী (Children as active learner)
শিশুরা সহজাতভাবেই জন্মের পর থেকে অনানুষ্ঠানিকভাবে শেখে। জন্মের পর থেকে প্রতিনিয়ত অভিজ্ঞতা ও পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে শিশু বেড়ে ওঠে। বেড়ে ওঠার এই প্রক্রিয়ায় শিশুর সক্রিয় ও সহজাত অংশগ্রহণই তার শিখনের মূল ভিত্তি। এমতাবস্থায় চারপাশের মানুষ ও পরিবেশ সম্পর্কে জানার দুর্নিবার আগ্রহ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখার জন্য শিশুকে সক্রিয় অংশগ্রহণের সুযােগ তৈরি করে দিতে হবে। কেননা শিশু স্বভাবগতভাবেই সক্রিয় শিক্ষার্থী। আর তাদের বিকাশ ও শিখন-প্রক্রিয়া যেহেতু বাড়ি, বিদ্যালয় ও চারপাশের সামাজিক পরিবেশ দ্বারা প্রতিনিয়ত প্রভাবিত হয় সেহেতু সকল পর্যায়ে তার সক্রিয় শিখনের সুযােগ সৃষ্টিই শিশুর বিকাশ ও শিখনের মূলমন্ত্র।
- পরিবারের সম্পৃক্ততা (Family involvement)
পারিবারিক পরিবেশ যথাযথভাবে শিশুর বেড়ে ওঠার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। শিশুর ব্যক্তিত্ব, নিজের সম্পর্কে ধারণা, মূল্যবােধ ও দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশ মা-বাবা ও পরিবারের অন্য সদস্যদের দ্বারা তাৎপর্যপূর্ণভাবে প্রভাবিত হয়। শিশুর যত্ন সম্পর্কে মা-বাবার জ্ঞান, প্রত্যাশা ও সন্তান লালন-পালনের ধরন শিশুর পরবর্তী জীবনের নানা দিকের উপর প্রভাব ফেলে। এছাড়াও শিশুর নিজের যত্ন নেওয়ার ক্ষমতা, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি, বিদ্যালয়ে তার শেখার প্রক্রিয়া এবং সমাজে অন্যান্যদের সাথে মিলেমিশে থাকার প্রবণতা তার বেড়ে ওঠাকে প্রভাবিত করে। এক্ষেত্রে মা-বাবা হলেন একাধারে শিশুর প্রথম শিক্ষক এবং শিশুর পরিপূর্ণ বিকাশ সাধনে বিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ অংশীজন। সুতরাং শিশুর বিকাশে পরিবার একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক এবং প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষায় শিশুর সাফল্যের জন্য পরিবারের সম্পৃক্ততা অত্যন্ত জরুরি।
- স্কুল-সক্রিয় সামাজিক প্রতিষ্ঠান (School as responsive social institute)
বিদ্যালয় বৃহত্তর সমাজেরই একটি ক্ষুদ্র সংস্করণ এবং এটি পরিবার ও সমাজের সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করে। প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা প্রদানের ক্ষেত্রে স্কুলকে এমন কিছু বিষয়ে গুরুত্ব প্রদান করতে হয় যা শিশুর জানার আগ্রহে উদ্দীপনা দিতে, নতুন পরিবেশের
সঙ্গে খাপ খাওয়াতে ও শারীরিক, মানসিক, বুদ্ধিবৃত্তিক, নৈতিক ও নান্দনিক, তথা সার্বিক বিকাশ নিশ্চিত করতে অত্যন্ত জরুরি।
বিষয়সমূহ হলো:
- শিশুর পারিবারিক প্রেক্ষাপট বােঝা এবং বাবা-মা ও পরিবারের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সদস্যের সাথে অংশীদারিত্ব ও সম্পর্ক স্থাপন করা;
- সামাজিক প্রেক্ষাপট ও প্রয়ােজন বােঝা এবং যথাযথভাবে সামাজিক শক্তি ও সম্পদকে কাজে লাগানো;
- জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রবণতা বােঝা এবং সে অনুযায়ী কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা।
এক্ষেত্রে স্কুলকে সক্রিয় সামাজিক প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা পালন করতে হবে। শিশুর প্রস্তুতির সঙ্গে যেহেতু পরিবার ও স্কুলের প্রস্তুতি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত সেহেতু শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে স্কুলের ভূমিকা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হয়েছে ।
- একীভূততা (Inclusiveness)
একীভূততা মানে ভিন্নতাকে সম্মান করে এবং মেনে নিয়ে সকল শিশুর অংশগ্রহণের সুযােগ ও সফলতার কথা চিন্তা করে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করা। প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাক্রম এবং শিখন-শেখানাে পদ্ধতি ও উপকরণ জাতি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, সক্ষমতা, অর্থনৈতিক অবস্থা নির্বিশেষে সব ধরনের শিশু এবং তাদের পরিবারের চাহিদা ও সুযােগের কথা মনে রেখে প্রণয়ন করা হয়েছে। শিখন-শেখানাে পদ্ধতি ও পরিবেশ যথেষ্ট নমনীয় এবং শিশুর স্বতন্ত্র চাহিদা ও শিখন-শেখানোর কৌশলের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। তাই শিক্ষাক্রম প্রণয়ন থেকে শুরু করে স্কুল ও পরিবার পর্যায়ে বাস্তবায়নের সকল ধাপে একীভূততাকে মূলনীতি হিসেবে অনুসরণ করা হয়েছে।
- সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য (Culture and heritage)
আত্মসম্মান ও আত্মমর্যাদাবােধ জাগ্রত করার জন্য শিশুদের নিজস্ব সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে নিজের স্বকীয়তা সম্পর্কে আত্মবিশ্বাসী করে গড়ে তােলা জরুরি। পাশাপাশি অন্যের সংস্কৃতিকে সম্মান করার অভ্যাস গড়ে তােলাও গুরুত্বপূর্ণ। শিখনের সকল ক্ষেত্রে বড়দের সহায়তায় বাড়িতে, স্কুলে এবং সমাজে সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যনির্ভর শিক্ষাপরিবেশ নিশ্চিত করতে শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যনির্ভর শিখনকে মূলনীতি হিসেবে অনুসরণ করা হয়েছে।
- সম্পর্ক (Relationship)
শিশুর বিকাশ ও শেখা বহুগুণে বেড়ে যায় যদি তার সঙ্গে অন্য শিশুর, শিক্ষকের কিংবা বড়দের সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। যখন পরিবারের সদস্য কিংবা সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে শিক্ষকের সম্পর্ক গড়ে ওঠে তখন সার্বিকভাবে প্রারম্ভিক শিক্ষার মান বৃদ্ধি পায়।
পরবর্তীতে বৃহত্তর পরিসরে সামাজিক ও মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন মানুষ হিসেবে শিশুদের গড়ে তুলতে প্রাথমিক শিক্ষার প্রথম ধাপে সম্পর্ক তৈরির বিষয়টিকে মূলনীতি হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে।
- পারিপার্শ্বিক পরিবেশ (Immediate environment)
পারিপার্শ্বিক পরিবেশ শিশুর বিকাশ ও শিখনকে প্রভাবিত করে। সার্বিক সামাজিক পরিবেশ প্রারম্ভিক শিক্ষার নীতি-নির্দেশনাকেও প্রভাবিত করে। আবার প্রারম্ভিক শিক্ষা সম্পর্কে মা-বাবার প্রত্যাশাকে পারিপার্শ্বিক পরিবেশ প্রভাবিত করে। শিশুর সার্বিক বিকাশও শিখন নিশ্চিত করতে প্রারম্ভিক শিক্ষায় পারিপার্শ্বিক ও সামাজিক পরিবেশের প্রতি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। নিকট পরিবেশ ও চারপাশে শিশুর শেখার পর্যাপ্ত উপাদান রয়েছে। তাই শিশুর পরিপূর্ণ বিকাশে পরিবার, সমাজ ও বিদ্যালয়ের সমন্বিত ও সম্মিলিত প্রচেষ্টার প্রয়ােজন অপরিহার্য।
- পরিবেশবান্ধব (Environment friendliness)
প্রকৃতি ও পরিবেশ মানুষের অকৃত্রিম বন্ধু। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এই অবস্থার বিচ্যুতি পুরাে পৃথিবীকে মহা বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিয়েছে। আর তার শিকার হচ্ছে অপেক্ষাকৃত সুবিধাবঞ্চিতরা। একটি পরিবেশ বান্ধব প্রজন্ম এই বিপর্যয় ঠেকাতে অনন্য ভূমিকা পালন করতে পারে। আর এই ধারণার লালন করতে হবে জীবনের শুরু থেকেই। সেই লক্ষ্যে প্রারম্ভিক/ প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাক্রমে পরিবেশ বান্ধব বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে এর উন্নয়ন ও বাস্তবায়নের সকল ধাপে মূলনীতি হিসেবে অনুসরণ করা হয়েছে।